লেজার দিয়ে মশা মারবে চীনের তৈরি অত্যাধুনিক ডিভাইস? শুনতে আজব লাগলেও সত্যি। ভোরবেলা ঘুমের মাঝখানে মশার বিরক্তিকর ভোঁ ভোঁ শব্দ, কিংবা সন্ধ্যার পর জানালা খুলতেই হঠাৎ মশার ঝাঁক এই পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা সবাই কমবেশি হয়েছি। শুধু বিরক্তিই নয়, মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে।
এখনও পর্যন্ত মশা তাড়াতে আমরা সাধারণত ব্যবহার করে এসেছি ধূপ, অ্যারোসল স্প্রে অথবা বৈদ্যুতিক ব্যাট। কিন্তু এবার চীন তৈরি করেছে এমন একটি আধুনিক ডিভাইস, যা লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করে উড়ন্ত মশা শনাক্ত করে সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বংস করতে সক্ষম।
চীন উদ্ভাবন করেছে এক চমকপ্রদ প্রযুক্তি, যা লেজারের সাহায্যে উড়ন্ত মশা শনাক্ত করে সাথে সাথেই ধ্বংস করতে পারে। এই অত্যাধুনিক ডিভাইসের নাম “ফোটন ম্যাট্রিক্স“, যা বর্তমানে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে এবং ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম Indiegogo-তে অর্থ সংগ্রহের কাজ চলছে।
কীভাবে কাজ করে ফোটন ম্যাট্রিক্স?
ফোটন ম্যাট্রিক্স তৈরি করা হয়েছে অ্যান্টি–এয়ারক্রাফট সিস্টেমের প্রযুক্তি অনুসরণ করে। এতে ব্যবহৃত হয়েছে আধুনিক LiDAR (Light Detection and Ranging) প্রযুক্তি, যা লেজারের আলো ব্যবহার করে উড়ন্ত মশার গতি, আকার ও অবস্থান নির্ভুলভাবে শনাক্ত করে।
একবার শনাক্ত হওয়ার পরপরই একটি গ্যালভোনোমিটার চালিত লেজার মাত্র তিন মিলিসেকেন্ড সময়ের মধ্যে মশাটিকে নিধন করতে পারে এমনই দাবি করছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।
ডিভাইসটির ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা
- পূর্ণ অন্ধকারেও কাজ করতে সক্ষম।
- ৩০টি মশা নিধন করতে পারে প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ্চ ।
- তবে ১ মিটার/সেকেন্ডের বেশি গতিতে উড়তে থাকা পোকামাকড় শনাক্ত করতে পারে না, ফলে মাছি বা অন্যান্য দ্রুতগামী পোকা এতে ধরা পড়ে না।
বাজারে আসছে দুটি সংস্করণ
ফোটন ম্যাট্রিক্স বাজারে আসবে দুটি ভিন্ন মডেলে বেসিক এবং প্রো সংস্করণ। প্রতিটির কভারেজ ও কার্যক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন:
সংস্করণ | কভারেজ (ডিগ্রি) | কার্যক্ষম দূরত্ব |
বেসিক | ৯০ ডিগ্রি | ৩ মিটার পর্যন্ত |
প্রো | ৯০ ডিগ্রি | ৬ মিটার পর্যন্ত |
বিদ্যুৎ সরবরাহ:
- ওয়াল সকেটে প্লাগ ইন করে চালানো যাবে।
- অথবা রিচার্জেবল পাওয়ার ব্যাংক থেকেও চলবে।
- একবার চার্জ দিলে ৮ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত চালানো সম্ভব (মডেল অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে)।
নিরাপত্তা প্রযুক্তি মানব ও প্রাণীর সুরক্ষা নিশ্চিত
ডিভাইসটিতে মিলিমিটার–ওয়েভ রাডার যুক্ত করা হয়েছে, যা মানুষ বা পোষা প্রাণীর উপস্থিতি শনাক্ত করলে লেজার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে পরিবেশবান্ধব এবং নিরাপদ ব্যবহারের নিশ্চয়তা মিলছে।
প্রযুক্তির পেছনের ইতিহাস
এই ডিভাইসের পেছনে রয়েছে এক যুগান্তকারী ধারণা, যা প্রথম প্রস্তাব করেন ২০০৭ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী লোয়েল উড, যিনি ‘স্টার ওয়ারস’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন। তখন মোবাইল ফোন ও লেজার প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল প্রাথমিক প্রোটোটাইপ।
২০১৭ সালে এটি TED সম্মেলনে প্রথম প্রদর্শিত হয়, তবে সেই সংস্করণ ছিল মানবদৃষ্টির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বর্তমান সংস্করণে সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে নিরাপত্তা সার্টিফিকেশন যুক্ত করা হয়েছে, যদিও প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক না চীনা মানদণ্ড, তা স্পষ্ট করেনি।
প্রি-অর্ডার মূল্য ও ভবিষ্যৎ বাজার মূল্য
নির্মাতাদের প্রথম Indiegogo প্রকল্প হিসেবে এই ডিভাইসের তহবিল সংগ্রহ চলছে। প্রি-অর্ডারে মূল্য নির্ধারিত হয়েছে:
- বেসিক সংস্করণ: ৪৬৮ মার্কিন ডলার
- প্রো সংস্করণ: ৬২৯ মার্কিন ডলার
তবে বাজারে ছাড়ার পর খুচরা মূল্য যথাক্রমে ৬৯৭ ও ৮৯৭ ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি ফোটন ম্যাট্রিক্স সফলভাবে বাজারে আসে, তবে এটি হবে মশা নিয়ন্ত্রণে এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি। তবে এখনো পর্যন্ত এটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থাকায়, ব্যবহারকারীদের সাবধানতার সাথে এগোনোর পরামর্শ দিচ্ছেন অনেক প্রযুক্তিবিদ।
শেষ কথা
ফোটন ম্যাট্রিক্স প্রযুক্তির এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে, যেখানে কেমিক্যাল ছাড়াই লেজারের সাহায্যে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এটি শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং আধুনিক বিজ্ঞান ও নিরাপত্তার একটি দুর্দান্ত সংমিশ্রণ। সফল বাস্তবায়নের পর এই প্রযুক্তি শুধু চীনে নয়, বরং বিশ্বজুড়ে মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।